মোগরাইয়ের ফিরে আসা

09/21/2018

মোগরাইয়ের ফিরে আসা


অলংকরণ: তুলি

হিজলতলী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নদী। নদীর ওপারে রয়েছে একটি জঙ্গল। সেখানে প্রচুর বনমোরগের বাস। জঙ্গলে বেড়ে ওঠা মোরগদের মধ্যে বুদ্ধি, সাহস আর শক্তিতে মোগরাই সবচেয়ে এগিয়ে। জ্যান্ত কেঁচো, ছোট ইঁদুর কিংবা ব্যাঙের বাচ্চা শিকার করা মোগরাইয়ের জন্য কোনো ব্যাপারই না! এই বাড়াবাড়ি সাহসের জন্য বন্ধুরা তো বটেই, বড়রাও প্রায়ই সাবধান করে দেয় তাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
আজকাল জঙ্গলে বড্ড একঘেয়েমি লাগে মোগরাইয়ের। রোজ সেই একই খাবার আর ভালো লাগে না। ইদানীং কেঁচো আর ব্যাঙেও কেমন যেন অরুচি লাগে! তাই এক দুপুরে কাউকে কিছু না জানিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে গেল জঙ্গলের একেবারে শেষ প্রান্তে। সেখানে একটি বড় রাস্তার দেখা পেল সে। এই রাস্তা নাকি সোজা শহরে চলে গেছে।
মোগরাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে ট্রাক আর বাসের অবিরাম ছুটে চলা। হঠাৎ তার কানের কাছে কে যেন বলে উঠল 'হাই!'
চমকে উঠল মোগরাই। দেখল, চোখে গোলাপি সানগ্লাস আর গলায় বেগুনি রঙের বো টাই বাঁধা রংচঙে একটি মোরগ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মোগরাই তো হতবাক! মোরগটি তাকে বলল, 'আমার নাম স্যাম। আমি শহরে থাকি।' ঠিক হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে স্যাম মোগরাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিল তার ডান পাখা। স্যাম আরও বলল, 'শহরের কোলাহলে ক্লান্ত লাগলেই আমি চলে আসি এই জঙ্গলে। দুদিন এখানে কাটিয়ে আবার ফিরে যাই শহরে।' মোগরাই মনে মনে ভাবল, শহরে যাওয়ার এই তো সুযোগ! মোগরাইয়ের কত দিনের শখ শহর দেখার! স্যামের সঙ্গে একবার শহরে যেতে পারলে আর কখনো ফিরবে না সে এই নিরামিষ জঙ্গলে।

মোগরাই আর স্যামের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। পরের দিন মোগরাই স্যামকে খুলে বলল তার মনের কথা। সে শহরে যেতে চায়; আর তা শুনে স্যামও রাজি হয়ে গেল। দুই দিন বাদে ভোরের আলো ফুটতেই মোগরাই স্যামের সঙ্গে রওনা হয়ে গেল শহরের উদ্দেশে। হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গল পেরিয়ে তারা যখন বড় রাস্তার ধারে চলে এল, তখন সূর্যের তেজ বেশ কড়া। স্যাম চোখে সানগ্লাস পরে নিল। মোগরাই মনে মনে ভাবল, শহরে পৌঁছেই তাকে এ রকম একটি সানগ্লাস জোগাড় করতে হবে।

প্রায় দুই ঘণ্টা একটানা হেঁটে শহরে পৌঁছে গেল তারা। ট্রাক, বাস আর নানা রকম গাড়ির জটলা এড়িয়ে, উঁচু দালানকোঠা পেরিয়ে অবশেষে তারা পৌঁছাল স্যামদের বাসার গেটে। স্যাম ততক্ষণে কিন্তু সানগ্লাস আর টাই খুলে ফেলেছে। তার চেহারায় সেই আগের উচ্ছ্বাস কোথায়! সে চুপিসারে গেটের নিচ দিয়ে মোগরাইকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকল। মোগরাই বুঝল, স্যাম কাউকে কিছু না জানিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিল। চোরের মতো এইভাবে বাসায় ঢুকতে মোটেই ভালো লাগল না তার। সে দেখল, বিশাল বাড়িটির সামনে রয়েছে একটি বাগান। বাগানের এক কোনায় পাতলা কাঠ দিয়ে মোরগ-মুরগিদের জন্য ছোট একটি বাসা তৈরি করা হয়েছে। বাসার ভেতরে ঢুকতেই বোটকা গন্ধে গা গুলিয়ে এল মোগরাইয়ের। কী আশ্চর্য! শহরের মোরগ-মুরগিরা ঘরের মধ্যেই এভাবে টয়লেট করে! জঙ্গলে কিন্তু এ রকমটি চলে না।

মোগরাই নাক চেপে ঘরে ঢুকছে, ঠিক এমন সময় তাকে দেখে তেড়ে এল একটি মুরগি। মুরগিটি ডিমে তা দিচ্ছিল ঘরের এক কোনায় বসে। তাই হঠাৎ নতুন একজনের আগমনে মহা বিরক্ত সে। স্যাম তাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ঠান্ডা করল এবং মোগরাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মোগরাই অবাক হয়ে লক্ষ করল, মুরগিটি মাত্র চারটি ডিমের ওপর বসে তা দিচ্ছে! জঙ্গলে সে কখনো কোনো মুরগিকে সাতটি ডিমের কমে তা দিতে দেখেনি। কারণ জিজ্ঞেস করতেই হু হু করে কেঁদে উঠল মুরগিটি। বলল, 'জানো, আমি মোট ষোলোটি ডিম পেড়েছি। কিন্তু বাড়ির মালিক বারোটি ডিমই নিয়ে গেছে। এখন বাকি আছে মাত্র চারটি ডিম। জানি না কয়টি ছানা হবে!' চোখ মুছতে মুছতে মুরগিটি আবার ডিমে তা দিতে বসল। মুরগিটিকে এভাবে কাঁদতে দেখে মোগরাইয়ের চোখেও পানি চলে এল।

মোগরাইয়ের পেট ক্ষিধে চোঁ চোঁ করছে। একটু পর তাদের খেতে দেওয়া হলো। সবাই হইহই করে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মোগরাই অবাক হয়ে লক্ষ করল, তাদের খেতে দেওয়া হয়েছে মানুষের ফেলে দেওয়া বাসি খাবার। কী বিকট তার গন্ধ! মোগরাই অনেক চেষ্টা করেও কিছু খেতে পারল না। আজ প্রথমবারের মতো তার মনে হলো, জঙ্গলের খাবার কত টাটকা আর ভালো!

ভীষণ ক্লান্ত মোগরাইয়ের সন্ধ্যা হতেই খুব ঘুম পেল। কিন্তু ঘুমাতে গিয়েও আরেক বিপত্তি। এতটুকু ঘরে ছানাপোনাসহ মোট তেত্রিশটি মোরগ-মুরগি! ক্ষুধার কষ্ট, ঘরের উৎকট গন্ধ আর মুরগির গাদাগাদিতে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা মোগরাইয়ের! জঙ্গলে শিয়াল-বেজির ভয় আছে বটে, কিন্তু এই গন্ধ সহ্য করার চেয়ে সে ঢের ভালো! মোগরাই এতটুকুও ঘুমাতে পারল না রাতে।

পরদিন সকালে ঘরের দরজা খুলে দিতেই এক দৌড়ে বেরিয়ে এল মোগরাই। খুব অসুস্থ লাগছে তার। এই দুরবস্থা দেখে স্যামের নিজেকে বড্ড অপরাধী বলে মনে হলো। কেন যে সে মোগরাইকে শহরে এনেছিল! সকালের খাবারের সবচেয়ে ভালো অংশটুকু স্যাম মোগরাইকে দিল। কিন্তু খুব সামান্যই খেতে পারল মোগরাই। শহরে যে এত খারাপ লাগবে, তা সে কখনোই ভাবতে পারেনি! মোগরাইয়ের অবস্থা দেখে স্যাম মোগরাইকে বলল, 'চলো, তোমাকে আবার জঙ্গলে রেখে আসি।' এই কথা শুনে মোগরাই আনন্দে কেঁদে ফেলল। সে আগে কখনো বুঝতে পারেনি জঙ্গলকে সে এতটা ভালোবাসে!

মোগরাই আর স্যাম এবার রওনা হলো জঙ্গলের উদ্দেশে। জঙ্গল পৌঁছেই প্রাণভরে নিশ্বাস নিল মোগরাই। এবার স্যামের বিদায় নেওয়ার পালা। স্যাম তার সানগ্লাসটি চোখ থেকে খুলে মোগরাইকে পরিয়ে দিয়ে বলল, 'আমার পক্ষ থেকে এটা তোমার উপহার। ভালো থেকো বন্ধু।' সানগ্লাস পেয়ে যে কী খুশি হলো মোগরাই! স্যাম রওয়ানা হয়ে গেল শহরের উদ্দেশে। আর মোগরাই পা বাড়াল তার আস্তানার উদ্দেশে। চোখে তার গোলাপি সানগ্লাস। কিন্তু সানগ্লাস পরে একদম ভালো লাগছে না তার। খালি চোখে দেখা জঙ্গল সানগ্লাস চোখে দেখা জঙ্গলের চেয়ে অনেক বেশি সবুজ, উজ্জ্বল আর সুন্দর। তাই সানগ্লাস কপালে উঠিয়ে সে দ্রুতগতিতে ছুটে চলল জঙ্গলের গহিনে তার আস্তানায়। সেখানে নিশ্চয়ই সবাই অপেক্ষা করছে তার জন্য।

© 2020 Visual Art BD
Powered by Webnode
Create your website for free! This website was made with Webnode. Create your own for free today! Get started